ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া যেখানে শেষ হয়ে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা শুরু হয়েছে, সেখানকার সীমানাবর্তী পাঁচ গ্রাম– ইছারচালা, মনতলা, খাজনাগড়া, সিংহচালা ও তেবাদিয়া। ফুলবাড়িয়া মধুপুরের গা ঘেঁষে হলেও গ্রামগুলো কাগজে-কলমে ঘাটাইলের অন্তর্ভুক্ত। কয়েক বছর আগে পাকা রাস্তার অভাবে এ অঞ্চলে যাতায়াত ছিল কষ্টকর; ফুলবাড়িয়া-মধুপুর হয়ে ঘাটাইল বরাবর প্রশস্ত সড়ক তৈরি হওয়ায় প্রধান সড়কে যাতায়াত এখন মসৃণ।
দিনকয়েক আগে গ্রামগুলো আবারও ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। এখানে সমতলে বসবাসরত আদিবাসী বিশেষত গারো বংশোদ্ভূত অনেকে বাস করে। পাশাপাশি বাস করে প্রান্তিক বাঙালিরাও। ‘হতদরিদ্র’ বলতে যা বোঝায়, তাতেও এই পাঁচ গ্রামের গারো ও প্রান্তিক বাঙালির বড় অংশকে বোঝানো সম্ভব নয়। এই গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষ নিজেদের পৈতৃক যা সামান্য জমি, সেটা বিক্রিকেই একটি সময় পর্যন্ত সবচেয়ে সুবিধাজনক পেশা হিসেবে দেখেছে। ফল হিসেবে একসময় তারা বেশির ভাগই হয়ে পড়ে ভূমিহীন।
গ্রামের নাম: সিংহচালা। কথা হয় অজিত বর্মণ নামে ২২-২৩ বছরের এক তরুণের সঙ্গে। অজিত আমাদের নিয়ে যায় সিংহচালা উপাসনা কেন্দ্রে। গ্রামগুলোর প্রতিটিতেই আছে মাটির তৈরি দোচালা উপাসনা কেন্দ্র। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিভিন্ন বয়সী লোকজন উপাসনা কেন্দ্রে সমবেত হয়ে প্রার্থনা, আনন্দ গীতে নিজেদের সমর্পণ করে। আমাদের কথা হয় সমরচন্দ্র বর্মণ [৩৫], সুধা রানী [৩০], অনিতা রানী [২২]সহ অনেকের সঙ্গে।
অধিকাংশের একই পরিস্থিতি– পৈতৃক কৃষিজমি বিক্রি করে দিয়ে সামান্য ভিটায় কোনোক্রমে আছেন। পেশা বলতে আনারস বাগান, ড্রাগন বাগান, পেয়ারা বাগানে দিনমজুরির কাজ। শহুরে ভদ্রলোকরা সস্তায় বিঘায় বিঘায় জমি কিনে এসব বাগান পরিচালনা করছেন এই অঞ্চলে। বিক্রি করে দেওয়া একসময়ের ‘নিজেদের’ জমিতেই তারা বর্তমানে দিনমজুর। তাদের অধিকাংশ, বিশেষত নারীরা– আনারস বাগানে কাজ করে সারাদিনে ১৪০ টাকা আয় করেন। জি, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে সারাদিনে এখানকার নারীদের কাজের মজুরি জনপ্রতি ১৪০ টাকা! পুরুষদের কিছু বেশি– ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা।
এই পাঁচ গ্রামে আমরা উন্নয়ন বলতে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন দেখি; মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। স্বাস্থ্যসেবা? ফুলবাড়িয়া উপজেলা হাসপাতালে ১২ লাখ মানুষের জন্য ১২ জন চিকিৎসক আছেন; ঘাটাইলেও কমবেশি তা-ই। উপজেলা হাসপাতালে সর্বোচ্চ যে সার্জারি হয়, তা সিজারিয়ান অপারেশন। এ বাদে সব অপারেশনের জন্যই ছুটতে হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর শিক্ষা? এই পাঁচ গ্রামের গারো শিশুরা নিজেদের ভাষা বা বর্ণমালা শেখার সুযোগ পায় না। সাধারণ স্কুলে তারা গেলেও অচিরে ঝরে পড়ে। আনারস কি ড্রাগন বাগানই হয়ে ওঠে তাদের অবলম্বন। অন্যদের জন্য যে স্কুল, তার লেখাপড়ার মান নিয়ে যত কম বলা যায়, তত ভালো; আর ফুলবাড়িয়া কি ঘাটাইল কলেজ থেকে ক’জন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়, তা কড়ে আঙুলে গুনেই শেষ হয়।
কারিগরি শিক্ষা? এই অঞ্চলের গারো ও প্রান্তিক নারীরা বিপুল পরিশ্রমী, বিশেষত গারো নারীদের ঐতিহ্যবাহী বুনন ও তাঁতশিল্পে যে জন্মগত ব্যুৎপত্তি, তা প্রাতিষ্ঠানিক যত্নের অভাবে এখন প্রায় বিলুপ্ত। এ অঞ্চলের বাঙালি নারীরাও কুটিরশিল্পে বিশেষ পারদর্শী, তা পার্শ্ববর্তী ফুলবাড়িয়ার নারীদের তৈরি হোগলা পাতার কুটিরপণ্যের বাজার চাহিদা দেখে বোঝা যায়। যদিও কারিগরি শিক্ষার জন্য সরকারি বা বেসরকারি কোনো উদ্যোগ– হোক তা নারী কিংবা পুরুষের জন্য; ঘাটাইলের পাঁচ গ্রাম ঘেঁটে তার দেখা মেলে না।
মুদ্রাস্ফীতি শুধু ঢাকায় বসবাসরত মানুষের জন্য নয়; ঘাটাইলসহ সারাদেশের প্রতিটি গ্রামের মানুষেরও চাল-ডাল-তেল-ডিম কিনতে হয়। নিত্যপণ্যের যে লাগামছাড়া দাম, তার শিকার সিংহচালার সুধা রানী কি অনিতা রানীরাও; তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে আয় করলে, দিনে ৩০০ টাকা, চার-পাঁচজনের সংসার, ন্যূনতম দিনযাপন কোন্ অঙ্কে সম্ভব? এর মধ্যে মানব উন্নয়ন পরিকল্পনা? আমাদের শহুরে চোখ ও অন্তরের পক্ষে তা বুঝে ওঠা কষ্টকর বৈকি!
২.
মানবসম্পদের এই কঙ্কালসার চিত্র কি কেবল ফুলবাড়িয়া-ঘাটাইলের পাঁচ গ্রামের বাস্তবতা? ঢাকা ছেড়ে উত্তর বা দক্ষিণে একশ থেকে দেড়শ কিলোমিটার পার হলেই আপনি ঘন গ্রাম পাবেন। মফস্বল শহরও পাবেন, দ্রুত তা পেরিয়ে আবার নিভৃত গ্রাম পাবেন, সবুজ-নিবিড় গ্রামের ভেতর আপনি পাবেন এক করুণ বাস্তবতা। যে উন্নয়নের কথা আমরা বলি, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক আসলে কতখানি?
গত ২ সেপ্টেম্বর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের [ইআরএফ] সঙ্গে আলাপচারিতায় অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘এখন মর্যাদা বাড়ানোর প্রকল্প [প্রেস্টিজ প্রজেক্ট] করার সময় নয়। এখন গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সময়।’ তিনি বলেন, ‘ভালো শিক্ষা ছাড়া যত অবকাঠামোই বানানো হোক না কেন, তা কঙ্কালই থাকবে।
শুধু অবকাঠামো দিয়ে আমরা কখনও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হতে পারব না। অবকাঠামোর রক্তমাংস হলো মানবসম্পদ।’ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা বড় বড় প্রকল্প করছি। এসব প্রকল্প ঋণের টাকায় করা হচ্ছে। কিন্তু ঋণ পরিশোধ তো করতে হবে। তাই কীভাবে ঋণ পরিশোধ করা হবে, তার পরিষ্কার পরিকল্পনা থাকতে হবে। কোন ধরনের প্রকল্প নেওয়া হবে, তা-ও বিবেচনায় রাখতে হবে।’
কোন ধরনের প্রকল্প? যে প্রকল্পে সরাসরি মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্ভব, সেরকম প্রকল্পকে প্রাধান্য দিতে হবে আমাদের দায়িত্বশীলদের। যে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ গ্রাম থেকে গ্রামে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে, তাদেরসহ সারাদেশের মানবসম্পদ, বিশেষত গরিব ও নিম্নবিত্তদের বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যার উদ্দেশ্যে সরকারকে প্রকল্প নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩.
২ সেপ্টেম্বর, শনিবার ঢাকার দ্রুতগতির উড়াল সড়ক [এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে] উদ্বোধন হলো। যান চলাচলের প্রথম দিন থেকেই দেখা যায়, এক্সপ্রেসওয়ের ওপর কেবল ব্যক্তিগত গাড়িই চলছে, বাস চলছে না। স্থানে স্থানে ওঠানামার ব্যবস্থা না থাকায় আদৌ এই রাস্তায় ঢাকার মূল গণপরিবহন অর্থাৎ বাস চলাচলের বাস্তবতা নেই। গাড়ি চোখের পলকে এক্সপ্রেসওয়ে পাড়ি দিয়ে র্যাম্প থেকে নেমে, সেটা বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি, মহাখালী বা ফার্মগেট– যেখানেই হোক, বিশাল জ্যামে ‘কূল নাই কিনার নাই’
অবস্থা! অবশ্য বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট ১০ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া নিশ্চয়ই ঢাকার যানজটে নাস্তানাবুদ হওয়া মানুষের জন্য সুখবর।
অবশ্য কোন্ শ্রেণির মানুষের জন্য সুখবর বয়ে আনল এক্সপ্রেসওয়ে? যার বা যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে এবং আসার পথে ৮০ টাকা ও ফেরার পথে ৮০ টাকা, প্রতিদিন কমপক্ষে ১৬০ টাকা টোল যারা দিতে পারে, তাদের জন্য। বিমানবন্দর থেকে বনানীর পথে লক্কড়ঝক্কড় বাসের জানালা দিয়ে সতৃষ্ণ চোখে বেশির ভাগ মানুষ দেখছেন– মাথার ওপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে সাঁই সাঁই করে ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে চলে যাচ্ছেন গাড়ির মালিকরা!
একটি দেশের গণপরিবহন কত নিকৃষ্ট হতে পারে, তার উদাহরণ ঢাকা শহরের গণপরিবহন। বাস নামের ‘প্রহসন’গুলো মালিকরা কেন এ রকম হতশ্রী অবস্থায় রাস্তায় চালান, তারাই জানেন। কেন লাখ লাখ প্রাইভেট কারের মহোৎসব না করে উন্নত ও প্রথম শ্রেণির বাস চালু করে না বিআরটিসি বা সিটি করপোরেশন? বাস মালিকদের ভয়ে? কারা সাধারণ যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাঙাচোরা বাসের মধ্যে গায়ে গা লাগিয়ে, দাঁড়িয়ে গরমে সেদ্ধ হয়ে, নরক যন্ত্রণার মধ্যে নগরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাড়ি দিতে বাধ্য করেন? গাড়িওয়ালাদের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকায় পাঁচতারকা রাস্তা বানানো সম্ভব; সাধারণ মানুষের জন্য ঢাকা শহরে গণপরিবহন সম্ভব হয় না। হায়!
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com