Skip to content

অন্তরে বাহিরে চিত্রাঙ্গদা: নারীর আত্ম অন্বেষণ

অন্তরে বাহিরে চিত্রাঙ্গদা: নারীর আত্ম অন্বেষণ

সৌন্দর্য নারীর অহংকার। কিন্তু একমাত্র সৌন্দর্যই কী নারীসত্তার মাপকাঠি! নারী স্বাতন্ত্র্য, নারীর রূপ-যৌবনের দার্শনিক সত্য অন্বেষণমুখী ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকটি যুগে যুগে মানুষকে নানাভাবে আন্দোলিত করেছে। ভারত-বাংলাদেশে নানাভাবে এ নাটক উপস্থাপিত হয়েছে। সম্প্রতি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকটি ভিন্ন ভাবনায় ভিন্ন মাত্রায় মঞ্চে এনেছে। নাটকটির নামকরণ করেছেন ‘অন্তরে বাহিরে চিত্রাঙ্গদা’। নির্দেশনায় প্রখ্যাত অভিনেত্রী সারা যাকের। এ নাটকে নারীবাদী নতুন দৃষ্টিকোণে চিত্রাঙ্গদা-অর্জুনের সম্পর্কের মনস্তত্ত্বকে ভিত্তি করে নারীর আবেগ, সৌন্দর্য সত্তা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে নৃত্য-সংগীত-অভিনয়ের অদ্বৈত নান্দনিক ভাষ্যে তুলে ধরেছেন।

‘চিত্রাঙ্গদা’ ১৮৯২ সালে কাব্যনাট্য রূপে এবং ১৯৩৬ সালে নৃত্যনাট্য রূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন। মহাভারতে অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার কাহিনি এর মূল উপজীব্য। এ নাটক মানবীয় ঘূর্ণাবর্তে নারিত্বের জটিলতার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রূপযৌবন-সৌন্দর্যের স্থায়িত্বহীনতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিচয়ের গুরুত্ব বিবৃত করেছেন। আখ্যানে মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা অর্জুন দ্বারা ভালোবাসার প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যাত হলে আত্মদহনের অনলে পুড়তে থাকেন। দেবতা মদন চিত্রাঙ্গদার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে এক বছরের জন্য চিত্রাঙ্গদাকে অপরূপ সুন্দর ও যৌবনবতী করে দেন। ফলে অর্জুন প্রেমে পড়ে যায়। এত সুখ-উচ্ছ্বাস-অবগাহনের মধ্যে দেবতা মদন প্রদত্ত সময় যতই ফুরাতে থাকে, চিত্রাঙ্গদার মধ্যে ততই দ্বন্দ্ব উপস্থিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে আত্মদংশনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ওঠেন চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন যখন জানবে চিত্রাঙ্গদা রূপ-সৌন্দর্য-লাবণ্যহীন, তখন কী হবে চিত্রাঙ্গদার? অর্জুন কাকে ভালোবাসে– চিত্রাঙ্গদার বাহ্যিক রূপ-সৌন্দর্যকে, নাকি চিত্রাঙ্গদাকে? 

নাটকে চিত্রাঙ্গদা চরিত্রে দু’জন অভিনয় করেছেন। ফারজানা মুক্তো ও র‍্যাচেল প্রিয়াংকা প্যারিস দু’জনই ভাব-ভাষায়, নৃত্য-চলন, অভিনয়-ছলাকলায় চরিত্রকে অনবদ্য করে তুলেছেন। দু’জনের ভাব প্রকাশে কী সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ, অপূর্ব লাবণ্যমণ্ডিত নৃত্যসুষমা, সংলাপের ছান্দিক প্রক্ষেপণ চিত্রাঙ্গদা চরিত্র নান্দনিক মাত্রায় বহু পরতে উপস্থাপিত। রূপলাবণ্যহীন চিত্রাঙ্গদার অবস্থা বোঝাতে অভিনেত্রীদ্বয় কালো রঙের ট্রাউজার পরিধান করেছেন। প্রসেনিয়াম মঞ্চের গভীর অরণ্যের সাজেস্টিক ডিজাইনে নৃত্য-গীত-অভিনয় আলোয় মুখর অর্জুনের ব্রহ্মচারী ব্রত। মঞ্চের একদিকে লাবণ্যহীন ফারজানা মুক্তোকে দেখা যায় মদনের শরণাগত হতে, অন্যদিকে অর্জুনকৃত প্রত্যাখ্যানের গ্লানি দৃশ্যরূপ পেতে থাকে। নান্দনিক নানা মাত্রায় নাটকটি আবর্তিত। ছোট রঙিন শাড়ির সাজেশনে সজ্জিত র‍্যাচেল প্রিয়াংকা প্যারিস যখন প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন, তখন যেন দর্শকের মর্মমূলে আঘাত হানছে।  

নারীবাদী পাসপেক্টিভে উপস্থাপিত এ নাটকটি অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার সম্পর্কের গভীর সত্যই প্রধানরূপে প্রতীয়মান। দেহছন্দ, চলন, নৃত্য ও ভাব প্রকাশের নিপুণতায় দু’জনের সম্পর্ক ও সম্পর্কের মনস্তত্ত্ব অনবদ্য জীবন্ত। ছোট ছোট ক্রিয়া, ভাব প্রকাশ ও মুভমেন্টে চিত্রাঙ্গদার প্রেমের সমর্পণ অংশ। অর্জুনকে দেখে তার বিহ্বলতা এবং প্রেমের দেবতা মদনকে খুলে বলা। গল্পকথনের মতো নৃত্য-গীত-অভিনয়ে দৃশ্যের পর দৃশ্যে তা উপস্থাপিত। দেবতা মদন চরিত্রে আবু নাসের ইউসুফের বরে কটাক্ষধারিণী রূপবতী হয়েই তবে অর্জুনকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হন। অন্যদিকে অর্জুন চরিত্রে মাহফুজ রিজভী ব্রহ্মচারী হিসেবে প্রথমে গেরুয়া বসন পরিধান করলেও পরে যখন শৌর্যবীর্যবান প্রতীকে আবির্ভূত হন সে রূপটি নায়কোচিত। কাহিনির শেষে এসে চিত্রাঙ্গদা সব দ্বিধা, আত্মপ্রতারণার ছদ্মবেশ ত্যাগ করে মিথ্যা ঝেড়ে ফেলে বাস্তব সত্যে দাঁড়ায়, তখন দর্শক যেন আন্দোলিত হয়ে ওঠে। এই বুঝি ‘নারীসত্তা’– ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী, পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে– সে নহি নহি, হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে– সে নহি নহি। যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সংকটে সম্পদে, সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে, পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।’

বাংলাদেশ ও ভারতে ‘চিত্রাঙ্গদা’র অসংখ্য প্রযোজনা হয়েছে। এসব নাটকে চিত্রাঙ্গদা চরিত্রের অভিনয়ে সাধারণত সুরূপ ও কুরূপে দুটো চরিত্র নির্মাণ করেন। কিন্তু নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের এ নাটকে সেটা করা হয়নি। একটি চরিত্রেই দু’জন অভিনয় করেছেন। চিত্রাঙ্গদা চরিত্রের উত্থান-পতন ও আবেগে সঙ্গে সঙ্গে দুই অভিনেত্রীর একই রকমের মেকাপ, অঙ্গসজ্জা ও পোশাকের পরিবর্তন ঘটেছে। নৃত্যে আরও ছিলেন মৌসুমী রানী বতর্জন, লাবণী বন্যা, বিদিশা সাহা, পিংকি রানী ভৌমিক, ঐশ্বরিয়া মিত্র ও রিংকি নাথ। নাটকে দেহছন্দ, চলন, নৃত্য ও ভাব প্রকাশ-অভিনয়ের নিপুণতায় দু’জনের সম্পর্কের নানা ভাব-অনুভাব-টানপোড়েন-রূপরেখা অপূর্ব নান্দনিকতায় উদ্ভাসিত। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে বর্ণিত সৌন্দর্যের ক্ষণস্থায়িত্ব নির্ভর ভাবনার চেয়েও চিত্রাঙ্গদা-অর্জুনের চাওয়া-পাওয়া, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, গ্রহণ-বর্জন, আবেগ-অনুভূতি, মান-অভিমান যেন অনবদ্য হয়ে উঠছিল দৃশ্যের ভাষায়।



বার্তা সূত্র